নিয়ন্ত্রণহীন শব্দ-সন্ত্রাস
মাইক বাজানোর রীতি আমাদের দেশে সবখানে আছে। এলাকায় এলাকায় মাইকের দাপট বেড়ে চলেছে। বর্তমানে দেখা যায়, ল্যাম্পপোস্টে-ল্যাম্পপোস্টে চোঙা। আমরা রিকশা, ভ্যান ও মিনিভ্যান থেকে রাস্তায় মাইকিংয়ের মাধ্যমে নানা ধরনের সরকারি-বেসরকারি প্রচারণা চালাতে দেখি, যেগুলো গুরুতর শব্দদূষণ করে থাকে। এছাড়াও জোরে জোরে চিৎকার, ঝগড়াঝাটি, মারামারি, সড়কে ক্যানভাসারদের প্রচারণাও নানা মাত্রায় শব্দদূষণের সৃষ্টি করছে। প্রসঙ্গত, জাপানে কারও বাসায় কেউ মারা গেলে বাড়ির মানুষ উচ্চস্বরে কাঁদে না বা শোক প্রকাশ করে না; কারণ হলো তাতে পাশের বাড়ির মানুষের সমস্যা হতে পারে। অথচ আমরা একই পৃথিবীর মানুষ, আমরা অকারণে অন্যের সমস্যা সৃষ্টি করতে পারলে নিজেকে ধন্য মনে করি।
বিজ্ঞান বলছে, মানুষ সাধারণত কথা বলে ৬০ ডেসিবেলে (সাউন্ডের একক ডেসিবেল)। ৮৫ ডেসিবেলে বেশিমাত্রার শব্দ মানুষের জন্য ক্ষতিকর। কতটা আওয়াজ গ্রহণযোগ্য হতে পারে সেসব বিষয়ে অনেক গবেষণা হয়েছে। গবেষণায় দেখা গেছে, হোটেল ও অফিসে মানুষ ৬০ ডেসিবেল সাউন্ডে কথা বলে। বাসাবাড়িতে কথা বলে ৫০ ডেসিবেলে। পাখির গুঞ্জন, লাইব্রেরি ও টেবিলে মানুষের কথা বলার শব্দ হয় ৪০ ডেসিবেলে। মানুষ ২০ ডেসিবেলের নিচের আওয়াজ শুনতে পায় না। একটি বুলডোজারের শব্দ ৮৫ ডেসিবেল। একদিন কেউ বুলডোজারের সঙ্গে থাকলে বা এর আওয়াজ শুনলে কানের স্থায়ী ক্ষতি হয়ে যায়। একদিন বলতে এক কর্মদিনকে বোঝানো হয়েছে। অর্থাৎ ৮ ঘণ্টা বুলডোজারের সঙ্গে থাকলে এই ক্ষতি হয়।
আমাদের দেশে অনেক এলাকায় এমনও রয়েছে, যেখানে প্রতিনিয়ত বুলডোজারের আওয়াজই উৎপন্ন হয়। সেই বিবেচনায় বুলডোজারের মাত্রায় শব্দদূষণ দিয়ে আমরা নিজেদের ক্ষতি করে চলেছি। বজ্রপাতের শব্দ ১২০ ডেসিবেল। গান শোনার ক্ষেত্রে ১০০ ডেসিবেল শব্দ হয়। গানের শব্দ আমাদের অনেক শোনা হয়। ১০০ ডেসিবেল মাত্রায় যদি দিনে ১৫ মিনিট করে গান শোনা হয়, তাহলে শ্রুতিশক্তির স্থায়ী ক্ষতি হতে থাকে। ঢাকায় যে হারে ডিজিটাল সাউন্ডে গান শোনা হয়, তার ক্ষতির মাত্রা এর চেয়ে অনেক বেশি। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাদের অনেককে এই হাইভোল্টেজ ক্ষতিকর আওয়াজ নিতে হচ্ছে। আমাদের দেশে কত মানুষ শ্রুতিসমস্যায় রয়েছেন সম্ভবত এর প্রকৃত জরিপ নেই।
শব্দদূষণ একধরনের সন্ত্রাস। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব মতে, কোনো এলাকায় ৬০ ডেসিবেল মাত্রার বেশি শব্দ হলে সেই এলাকা শব্দদূষণপ্রবণ এলাকার আওতায় আসবে। সংস্থার হিসাব মতেই ৬০ ডেসিবেল শব্দ মানুষের সাময়িক শ্রবণশক্তি নষ্ট করতে পারে। ১০০ ডেসিবেল শব্দ চিরতরে মানুষের শ্রবণশক্তি নষ্ট করে দিতে পারে। সম্প্রতি 'পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন'-এর এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে বিভিন্ন কারণে উচ্চশব্দের উৎসগুলো যেমন বাড়ছে, তেমনি শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা বাস্তবায়নে কর্তৃপক্ষের উদাসীনতায় সাম্প্রতিক শব্দদূষণ ভয়ংকর পর্যায়ে পৌঁছেছে।
বাংলাদেশে শব্দদূষণকে মোকাবিলায় কিছু আইন, নিয়ম ও বিধান কিন্তু রয়েছে। যেমন, পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫, পরিবেশ সংরক্ষণ বিধান ১৯৯৭, শব্দদূষণ (নিয়ন্ত্রণ) বিধিমালা ২০০৬ ইত্যাদি। এ আইনগুলো শব্দদূষণের সমস্যাকে সমাধান করতে বিস্তারিত দিকনির্দেশনা দেয়। কিন্তু দুঃখজনকভাবে এই আইনকানুনগুলোর কদাচিৎ প্রয়োগ দেখা যায়। এই আইনগুলোর বাস্তবায়নে কোনো কঠোর উদ্যোগ দেখা যায় না। সম্প্রতি হাইকোর্ট হাইড্রোলিক হর্নের ব্যবহার বন্ধে সরকারকে দিকনির্দেশনা প্রদান করেছে, কিন্তু সে ব্যাপারে তেমন কোনো উদ্যোগ দেখা যাচ্ছে না। অথচ হর্নের অযথা ব্যবহার বন্ধে আইনের প্রয়োগ ও সচেতনতা তৈরির বিকল্প নেই। ২০২১ সালের ২৩ নভেম্বর 'অকারণে হর্ন :স্বাস্থ্য ও অর্থনীতির ক্ষতির কারণ' শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকরা বলেছিলেন, আসলে শুধু আইন প্রয়োগ করে হর্ন বাজানো বন্ধে সাফল্য আসবে না। অযথা হর্ন বাজানো বন্ধে সঠিক পরিকল্পনা করে বাস্তবায়নে নামতে হবে। নাগরিকদের মানসিকতাতেও বদল আনতে হবে।
ঢাকা শহরে ভবন নির্মাণের ক্ষেত্রে প্রায়ই দেখা যায় দিন নেই, রাত নেই পাইলিং-এর কাজ, ইট ভাঙার যন্ত্র, সিমেন্ট মিকশ্চারের যথেচ্ছ ব্যবহার হচ্ছে। সময় সম্পর্কে কোনো বালাই নেই। বাংলাদেশে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের অধীনে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণ বিধিমালা রয়েছে। তাতে বলা আছে সন্ধ্যা ৭টা থেকে সকাল ৭টা পর্যন্ত নির্মাণকাজের এসব যন্ত্র চালানো যাবে না। আবাসিক এলাকার শেষ সীমানা থেকে ৫০০ মিটারের মধ্যে নির্মাণকাজের জন্য ইট বা পাথর ভাঙার মেশিন ব্যবহার করা যাবে না। কিন্তু ঢাকা শহরে আবাসিক এলাকার শেষ সীমানা বলে কিছু আসলে নেই। অন্তত বড় শহরগুলোতে অভিজ্ঞতা হলো মধ্যরাত, এমনকি রাতজুড়ে নির্মাণকাজ চলে। কারও ঘুমের ব্যাঘাত ঘটছে কিনা, শিশুদের পড়াশোনার ক্ষতি, অসুস্থ ও বয়স্ক ব্যক্তিদের কষ্ট কোনো কিছুই অসময়ে নির্মাণকাজ থামাতে পারে না।
বাংলাদেশের শব্দদূষণ নীতিমালা-২০০৬ অনুযায়ী আবাসিক এলাকায় সকাল ৬টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত সর্বোচ্চ শব্দসীমা ৫৫ ডেসিবেল এবং রাত ৯টা থেকে সকাল ৬টা পর্যন্ত শব্দের সহনমাত্রা ৪৫ ডেসিবেল। নীরব এলাকার জন্য এই শব্দসীমা যথাক্রমে সর্বোচ্চ ৫০ ও ৪০ ডেসিবেল, মিশ্র এলাকায় ৬০ ও ৫০ ডেসিবেল, বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০ ও ৬০ ডেসিবেল এবং শিল্প এলাকার জন্য সর্বোচ্চ শব্দসীমা ৭৫ ও ৭০ ডেসিবেল হওয়া উচিত।
মাত্রাতিরিক্ত শব্দদূষণ একটি শিশুকে বেড়ে ওঠার আগেই বধির হওয়ার দিকে ঠেলে দিচ্ছে। তাকে করে তুলছে অমনোযোগী ও বিকারগ্রস্ত। শব্দদূষণ হচ্ছে নীরব ঘাতক। আর দূষণ সৃষ্টিকারীরা অনেক সময় প্রত্যক্ষ ঘাতক। এই উভয় ঘাতকের বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার সময় এসেছে। শব্দদূষণ রোধে সবার আগে জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। যে কোনো মূল্যে আইনের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। তা না হলে আগামী দিনে বধির, বিকৃত, বিকারগ্রস্ত একটি জাতির ভার দেশকে বহন করতে হবে।
কিছু সময় রয়েছে, যখন মানুষ কোলাহলমুক্ত শান্তিপূর্ণ পরিবেশ চায়। রাজনৈতিক এখনকার কর্মসূচি যেন সেটা মানতে চায় না। মানুষকে কষ্ট দিয়ে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচি সফল করা যায় না। এ ব্যাপারটি রাজনৈতিক নেতারা ভেবে দেখতে পারেন। এ দেশে শব্দদূষণ বাড়ছে নিয়ন্ত্রণহীনভাবে। সংশ্নিষ্ট গবেষকরা বলেছেন, শব্দ নিয়ন্ত্রণের জন্য মানুষকে শুধু সচেতন করলে হবে না, মফস্বলসহ গ্রামীণ জনপদের মানুষকেও এর ভয়াবহতা সম্পর্কে জানিয়ে সচেতন করতে হবে। আইন করে অপরাধ দমন করা যত সহজ, তার চেয়ে সচেতনতা সৃষ্টি করে অপরাধপ্রবণতা কমিয়ে আনা আরও বেশি সহজ। সুতরাং, সামাজিক সচেতনতা বৃদ্ধির কাজটি আন্তরিকতার সঙ্গে চালিয়ে যেতে হবে আমাদের সবাইকে।
No comments