খাদ্যনিরাপত্তার ঝুঁকি মোকাবিলায় কতটা প্রস্তুত বাংলাদেশ
করোনার অভিঘাতের পর রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে সারা বিশ্বে খাবার ও জ্বালানির দাম বেড়েছে। বাড়তি মূল্যস্ফীতির কারণে অনেক দেশই হিমশিম খাচ্ছে। এই সংকটের মধ্যে নিত্যপণ্যের দাম যেন আরও বেশি অস্থির না হয়, সেজন্যই খাদ্য মজুত ঠিক রাখার ওপর জোর দিচ্ছে সরকার। এই মুহূর্তে বিশ্বে সবচেয়ে বেশি খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে কঙ্গো, ইথিওপিয়া, নাইজেরিয়া, ইয়েমেন, আফগানিস্তান, সুদান, দক্ষিণ সুদান, সোমালিয়া, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, হাইতি, নাইজার, কেনিয়া, মালাউ, বুরকিনা ফাসো, জিম্বাবুয়ে, গুয়েতেমালা, হন্ডুরাস, আফ্রিকান রিপাবলিক, চাদ, মাদাগাস্কার ও মালি। ভবিষ্যতে এসব দেশের অনেক মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগবে। এর মধ্যে ৭০ শতাংশ মানুষই তীব্র খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় থাকবে। এর প্রভাবে দারিদ্র্য বাড়বে সারা বিশ্বে। বিশ্ব খাদ্য সংস্থার নিয়মিত সাময়িকীতে বলা হয়েছে, ২০২৩ সালে বিশ্বের ৪৫টি দেশে বাড়তি খাদ্য আমদানির প্রয়োজন হওয়া দেশের মধ্যে ৩৩টিই আফ্রিকার। খাদ্য দুষ্প্রাপ্য হওয়ায় অপুষ্টিজনিত রোগব্যাধি যেমন বাড়বে, তেমনি মানুষের মধ্যে পুষ্টিহীনতাও বাড়বে। বাংলাদেশসহ এশিয়ার ৯টি দেশেরও নাম রয়েছে ঐ তালিকায়।
তবে চালসহ মৌলিক খাদ্যের বেশির ভাগই দেশীয় জোগাননির্ভর হওয়ায় সরবরাহ নিয়ে আগামী কিছুদিন বাংলাদেশের দুশ্চিন্তা কিছুটা কম। স্বাভাবিক সময়ে দেশের চাহিদার ৯৫ শতাংশ ধান-চালের জোগান দেশীয় কৃষিক্ষেত্র থেকেই আসে। আর কিছুটা সংকট দেখা দিলে আন্তর্জাতিক বাজার থেকে সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ চাল আমদানি করতে হয়। ১৯৮৮ সালে প্রণীত সরকারের বর্তমান খাদ্যনীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে প্রয়োজনীয় খাদ্য উৎপাদন নিশ্চিত করার মাধ্যমে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, কৃষকদের অধিক খাদ্য ফলনে উত্সাহ প্রদান, ফসল তোলার সময় কৃষকদের কাছ থেকে ভর্তুকি মূল্যে বা উত্সাহব্যঞ্জক মূল্যে শস্য ক্রয়, দেশে উৎপাদিত শস্যের সুষ্ঠু সরবরাহ ও বিতরণব্যবস্থা নিশ্চিতকরণ, নিম্ন আয়ের ব্যক্তির কাছে খাদ্যপ্রাপ্তি সহজ করা, শস্যের উৎপাদন খরচ এবং জনগণের ক্রয়ক্ষমতার সঙ্গে সংগতি রেখে খাদ্যমূল্য স্থির রাখা, উৎপাদিত কিংবা অন্য কোনো উৎস থেকে সংগৃহীত খাদ্যের যথাযথ সংরক্ষণ, দুর্যোগকালীন অবস্থা মোকাবিলার জন্য ‘খাদ্য মজুত’ ব্যবস্থা অথবা দুঃসময়ে ব্যবহৃত শস্যভাণ্ডার গড়ে তোলা, খাদ্যের মূল্য নিয়ন্ত্রণ, খাদ্য ব্যবস্থাপনা পদ্ধতিকে শক্তিশালী করে ক্রমান্বয়ে খাদ্যে ভর্তুকি কমিয়ে আনা ইত্যাদি। এগুলো অর্জনের জন্য ২০টি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য সামনে রেখে ৩২টি নির্দেশমালা প্রস্তুত করা হয়। খাদ্য নীতিমালা কখনো কখনো লক্ষ্য অর্জনের জন্য নির্ভরযোগ্য কার্যক্রম গ্রহণ করারও পরামর্শ দেয়। নীতিমালার প্রথম লক্ষ্য হচ্ছে ধীরে ধীরে খাদ্যঘাটতি কমিয়ে আনা এবং জনপ্রতি খাদ্য গ্রহণের মাত্রা বাড়িয়ে প্রতিদিন তা জনপ্রতি ১৬ আউন্সে উন্নীত করা। সামগ্রিক মূল্যস্ফীতির ধাক্কায় গত তিন মাস ধরেই বাংলাদেশে চাল-আটার বাজার ঊর্ধ্বমুখী। অবশ্য এই ঊর্ধমুখী প্রবণতাকে অযৌক্তিক বলেই মনে করছেন অনেকে। সম্প্রতি চাল-আটার ব্যবসার সঙ্গে যুক্ত বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতা কমিশনের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হয়েছে।
এদিকে বৈশ্বিক বিদ্যমান পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে বিশ্বব্যাংক তাদের সম্প্রতি প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলেছে, বর্তমান বৈশ্বিক প্রেক্ষাপটে বিশ্বের প্রায় সব দেশেই খাদ্য নিরাপত্তার ঝুঁকির মাত্রা ভয়ানকভাবে বাড়লেও খাদ্য নিরাপত্তা নিয়ে ঝুঁকিতে নেই বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে আফগানিস্তান, পাকিস্তান ও শ্রীলঙ্কা খাদ্যনিরাপত্তার বড় ঝুঁকিতে পড়েছে। কিন্তু বাংলাদেশে খাদ্যের মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বাংলাদেশ থেকে চাল রপ্তানি বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। গত ২৯ জুন থেকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকর করেছে সরকার। ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত তা বহাল থাকবে। সারা বিশ্বে খাদ্যসংকটের আশঙ্কা থাকলেও এই মুহূর্তে বাংলাদেশ অনেকটাই স্বস্তিতে রয়েছে। খাদ্যনিরাপত্তা নিয়ে কোনো ধরনের হুমকি নেই। যে কোনো ধরনের খাদ্যসংকট এড়াতে বাংলাদেশ অনেকটাই প্রস্তুত। বোরোর বাম্পার ফলনের পর অনাবৃষ্টির নেতিবাচক প্রভাবে আমন উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা অর্জন নিয়ে শুরুতে কিছুটা শঙ্কা থাকলেও এখন আর তা নেই। এর পরও ইতিমধ্যে সম্ভাব্য সংকট এড়াতে অতিরিক্ত ১০ লাখ মেট্রিক টন চাল আমদানির উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এর মধ্যে সাড়ে ৩ লাখ মেট্রিক টন চাল দেশে এসে পৌঁছেছে। আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে দেশের বাজারেও চালের মূল্য প্রতিনিয়ত বেড়েছে। কারণ হিসেবে বিশ্লেষকেরা বলছেন, পৃথিবী জুড়ে জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব ও যুদ্ধাবস্থায় উৎপাদন কমে যাওয়া এবং সরবরাহ চেইন সঠিকভাবে কাজ না করা। এ অবস্থায় সবার মাঝে ভীতি কাজ করছে। চাল উৎপাদনকারী দেশ দাম বাড়িয়ে দিচ্ছে। কোনো কোনো দেশ আবার অতিরিক্ত মজুতের পথে হাঁটছে। ফলে নিত্য ভোগ্যপণ্যের বাজারে অস্থিরতা বেড়েই চলেছে।
বিশ্বব্যাংক সতর্ক করে বলেছে, বিশ্বব্যাপী খাদ্যসংকট ভবিষ্যতে আরও বাড়বে। বিশ্বের প্রায় ৫০ শতাংশ ইউরিয়া সার ইউরোপ থেকে সরবরাহ করা হয়। গ্যাসের সংকটে একদিকে সারের উৎপাদন বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এতে সারের দামসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণের দামও বাড়ছে। ফলে কৃষি উৎপাদন ব্যয় বাড়বে। এতে কৃষিপণ্যের দামও বাড়বে। কয়েকটি দেশে মূল্যস্ফীতির হার বেড়ে খাদ্য দরিদ্র মানুষের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যেতে পারে। খাদ্য নিরাপত্তার পাশাপাশি পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য দরকার মাছ, মাংস, ডিম, দুধ, সবজির পর্যাপ্ততা। আর পুষ্টি নিরাপত্তার জন্য উল্লিখিত পণ্যগুলো সুষ্ঠুভাবে সংরক্ষণ ও সরবরাহের ব্যবস্থা করা বড় প্রয়োজন। বাংলাদেশে সবজি, মাছ ও ধান উৎপাদন যে পর্যায়ে উন্নীত হয়েছে, তা ঠিকমতো এগিয়ে গেলে, সঠিক সংরক্ষণের ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে খাদ্য রপ্তানিকারক দেশ হতে পারে বাংলাদেশ। পুষ্টি নিরাপত্তায় চালের বাইরে অন্যান্য খাবার গ্রহণ বাড়াতে হবে। বর্তমানে বাংলাদেশের খাদ্যগ্রহণের চিত্রে একমাত্র চালের পর্যাপ্ততা আছে। দিনে জনপ্রতি সাড়ে ৩০০ গ্রাম ভাত দরকার। সেই জায়গায় বাংলাদেশের মানুষ গড়ে ৪০০ থেকে ৪৫০ গ্রাম ভাত খায়। বাংলাদেশ এখন চাল উৎপাদনে বিশ্বের তৃতীয় দেশ। চীন ও ভারতের পর গত অর্থবছরে ইন্দোনেশিয়াকে পেছনে ফেলে বাংলাদেশ তৃতীয় স্থান অর্জন করেছে। প্রায় ১৮ কোটি মানুষের দেশে প্রতিদিনই কৃষিজমি কমছে। সেখানে আমাদের প্রধান পণ্য চাল উৎপাদনের ধারাবাহিক যে সফলতা আসছে, তার বড় অবদান আমাদের কৃষকদের।
উক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধকে কেন্দ্র করে পরাশক্তিগুলোর নিষেধাজ্ঞা ও পালটা নিষেধাজ্ঞার কারণে খাদ্যনিরাপত্তা হুমকির মুখে। করোনা মহামারি ও ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের মধ্যে বিশ্ব জুড়ে খাদ্যসংকটের আভাস দিচ্ছে বিশ্ব সংস্থাগুলো। সত্যিই খাদ্যসংকট দেখা দিলে গত তিন বছরের মতো আগামী বছরটাও এই পৃথিবীর মানুষের জন্য দুঃসংবাদের, তা নিয়ে শঙ্কিত সবাই। আমাদের খাদ্যের একটা বড় অংশ আমদানি করতে হয়। ডলারের দাম বেড়ে যাচ্ছে এবং যুদ্ধ পরিস্থিতি সহজে নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এ কারণে গম, ভোজ্যতেলের আমদানিমূল্য বেড়ে যাচ্ছে। আবার এগুলো এলসি করে আনাও বেশ কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে।
দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে খাদ্যশস্যসহ মাছ, পোলট্রি, তরিতরকারি, শাকসবজি ও ফলের উৎপাদন বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে গণমুখী কর্মসূচি, উত্পাদনমুখী প্রকল্প, বিনিময়মূলক কার্যব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। একদিকে খাদ্যের সংস্থান, অন্যদিকে কর্মের ব্যবস্থা করতে পারলে খাদ্যসংকট মোকাবিলা করা সহজ হবে।
No comments