সবুজ জ্বালানির পক্ষে
হঠাৎই বিদ্যুৎ নিয়ে ‘হতাশা ও আতঙ্কে’র ছড়াছড়ি দেখে খানিকটা বিস্মিত হচ্ছি। এই কয়েক দিন আগেই সারা দেশে বিদ্যুৎ ও জ্বালানিসংকট এতটা গভীর ছিল না। কভিড-১৯-এর আক্রমণে বেহাল থেকে বিশ্ব অর্থনীতি যখন ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করেছে তখনই হঠাৎ করে রাশিয়া ও ইউক্রেনের যুদ্ধের শুরু। এর প্রভাবে অন্য অনেক দেশের মতো আমাদেরও বেশ বিপদে পড়তে হয়েছে
নিঃসন্দেহে বিশ্ব অর্থনৈতিক সংকটের আঘাত এই খাতে বাড়ছে। কিন্তু চ্যালেঞ্জকে সম্ভাবনায় রূপান্তরের ঐতিহ্যও তো বাংলাদেশের রয়েছে। জন-আলাপটিকে সেদিকে ধাবিত না করে অনেকেই অযথা নিরাশার বাণী ছড়াচ্ছেন দেখে অবাক হয়েছি। নিঃসন্দেহে সময়টা এখন খুবই অনিশ্চিত। তাই দরকার আরো বেশি বিচক্ষণতার ও সুস্থিতির। মাথা ঠাণ্ডা রেখে সবাই মিলেই এই সংকটের মোকাবেলা করা দরকার।
বিশ্ববাজারে সব ধরনের জ্বালানি তেলের দাম কয়েক গুণ বেড়ে গেছে। পাশাপাশি যুক্তরাষ্ট্রের সংকোচনমূলক মুদ্রানীতির প্রভাবে বিশ্বের প্রায় সব মুদ্রার বিপরীতে ডলারের দাম বাড়ছে তো বাড়ছেই। সেই কারণেও জ্বালানি আমদানির মূল্য দেশি মুদ্রায় আরো বাড়ছে। আবার বিপুল বাণিজ্যিক ঘাটতির কারণে চলতি হিসাবেও বড় ধরনের ঘাটতি দেখা দিয়েছে। তাই লেনদেনের ভারসাম্যের ওপর চাপ পড়েছে। এ কারণে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমতে থাকায় ডলারের সরবরাহেও চাপ পড়ছে। সব মিলে বৈদেশিক খাতের অর্থনীতির পরিস্থিতি বেশ জটিল রূপ ধারণ করেছে। আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনের প্রধান উপকরণ হলো জ্বালানি তেল ও গ্যাস। প্রতিবছর এই খাতে সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয় করতে হয়। সার্বিক আমদানি মূল্য আয়ত্তের মধ্যে থাকায় এত দিন জ্বালানি তেল ও গ্যাস কিনতে আমাদের তেমন কোনো অসুবিধা হচ্ছিল না। কিন্তু জ্বালানি তেলের উচ্চমূল্য আর আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ার কারণে আমাদের বিদেশি মুদ্রা ও দেশি মুদ্রায় এ খাতে অর্থ জোগানে সমস্যা তৈরি হয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী পুরো বিষয়টিই খোলামেলাভাবে সবার সামনে তুলে ধরেছেন। বিদ্যুৎ চাহিদার বিপরীতে নিজেদের সক্ষমতা, অর্থের উৎস—সবই খোলাসা করে বলেছেন। একই সঙ্গে এই সংকট মোকাবেলায় সবাইকে সম্পৃক্ত হওয়ার কথাও বলেছেন। সেই সঙ্গে সংকট মোকাবেলায় বিদ্যুৎ লোড শেডিং ও কৃচ্ছ্র সাধনের কথাও বারবার বলেছেন। সংকট মোকাবেলায় অফিস টাইম কমিয়ে আনা, বিপণিবিতানগুলো অনেক রাত পর্যন্ত খুলে না রাখা—এই ধরনের বিষয়গুলোও ঠিক করে দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী এই সংকটের উৎস অনুধাবন করতে বলেছেন। তা থেকে বাঁচার উপায়গুলোর কথাও বলেছেন। তিনি এও বলেছেন যে সামনে আরো বড় ধরনের মন্দার আঘাত বা সংকট তৈরি হতে পারে। সময়োচিত এই সতর্কবার্তা দিয়ে তিনি সবাইকে মানসিকভাবে সংকট মোকাবেলার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করতে বলেছেন। তিনি কিন্তু কোনো আতঙ্কের কথা বলেননি। শুধু সাবধানী হতে বলেছেন।
আন্তর্জাতিক বাজারে যে এলএনজির দাম অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে এটি বোধ হয় কারো অজানা নয়। স্পট মার্কেট থেকে কিনে এই মুহূর্তে এলএনজি আমদানি করতে গেলে সরকারের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে বড় ধরনের চাপ তৈরি হয়। তাই আপাতত সরকার এলএনজির পথে পা বাড়াতে চাচ্ছে না। সামনে বৈশ্বিক মন্দাও আরো তীব্র হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। তাই বলে রিজার্ভের মতো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে যা খুশি তা-ই বলা একেবারেই উচিত হচ্ছে না। বরং এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে আইএমএফসহ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো থেকে কম সুদে দীর্ঘমেয়াদি ঋণ উদ্যোগ সরকার নিয়েছে, সে কথা স্পষ্ট করে বলার প্রয়োজন রয়েছে। আগেভাগে আইএমএফের সহায়তা নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে সরকার উপযুক্ত কাজই করেছে। এর ইতিবাচক প্রভাব লেনদেনের ভারসাম্যের ওপর পড়তে বাধ্য। বিদ্যুৎ বিভাগের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্য মতে, এ বছরের ১৬ এপ্রিল সর্বোচ্চ ১৪ হাজার ৭৮২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হয়। গত ১৩ বছরে বিদ্যুৎ খাতে অনেক বড় ধরনের পরিবর্তনও আমরা দেখতে পাই। এর মধ্যে অন্যতম হলো—বিদ্যুৎকেন্দ্রের সংখ্যা বৃদ্ধি পাওয়া, সঞ্চালন লাইন বৃদ্ধি, গ্রিড সাবস্টেশনের ক্ষমতা বৃদ্ধি, বিদ্যুতায়িত বিতরণ লাইন বৃদ্ধি। এ বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত দেওয়া তথ্য মতে, বিদ্যুতের গ্রাহকসংখ্যা বর্তমানে চার কোটি ৩৭ লাখ। ২০০৮ সাল পর্যন্ত এটি ছিল এক কোটি আট লাখ। আবার সেচ সংযোগসংখ্যাও গত ১৪ বছরে বেড়েছে কয়েক গুণ। ২০০৮ সালে সেচ সংযোগসংখ্যা ছিল দুই লাখ ৩৪ হাজার। বর্তমানে এটি বেড়ে দাঁড়িয়েছে চার লাখ ৭৩ হাজার।
বাংলাদেশে গত এক যুগে আমরা বিদ্যুৎ খাতে ব্যাপক উন্নয়ন দেখতে পেয়েছি। এ বছরই আমাদের বিদ্যুৎ উৎপাদনক্ষমতা দ্বিগুণ হয়। ঘরে ঘরে বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়ার আশ্বাস সরকার দিতে পেরেছিল সেই শক্তিবলেই। কিন্তু নয়া বিশ্ব বাস্তবতায় আমাদের নতুন করে এই খাতটি নিয়ে ভাবতে হবে। এখন যে অবস্থা সেখানে বিকল্প ভাবনাকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো বিজ্ঞের কাজ। আর এ প্রসঙ্গেই সবুজ জ্বালানির বিষয়ে আসি। এ বিষয়ে আমরা সবাই অবগত। গত বছরের ডিসেম্বরে ভারতের তৎকালীন পররাষ্ট্রসচিব হর্ষ বর্ধন শ্রিংলা গণভবনে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে এলে তখনো এ বিষয়টি নিয়ে অনেক গুরুত্বের সঙ্গে আলাপ হয়। কেননা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে পরিবেশবান্ধব জ্বালানি ব্যবহারের পক্ষে জনমত ক্রমেই বাড়ছে। সারা বিশ্বে সবুজ জ্বালানির উৎপাদন ও বিতরণ বেশ বেড়েছে। প্রযুক্তির কল্যাণে এর দামও উল্লেখযোগ্য হারে কমে চলেছে।
বেশ আগেই ‘মুজিব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা দশক ২০৩০’ প্রণয়ন করা হয়েছে। এর আগে আমরা দেখেছি ১০টি কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনের কার্যক্রম বাতিল করতে। এর বদলে সৌরবিদ্যুৎ, বায়ুচালিত বিদ্যুৎসহ নবায়নযোগ্য বিদ্যুতের ওপর এখন গুরুত্বারোপ করা হচ্ছে। আমরা দেখছি আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উৎপাদনে অনেক বেশি জোর দিয়েছে। আর ইউরোপে তো দিন দিনই এর বেশি বেশি প্রসার ঘটেছে। কিছুদিন আগে নিউ ইয়র্কে এক সম্মেলনে একজন প্রবাসী বাঙালি বিজ্ঞানী জানালেন যে বাংলাদেশের উপকূলে বিপুলসংখ্যক বায়ুচালিত বিদ্যুৎ প্লান্ট স্থাপনের সুযোগ রয়েছে। প্রযুক্তির উন্নতির কারণে এখন একেকটি উইন্ডমিল থেকে ছয় মেগাওয়াটের বেশি বিদ্যুৎ সহজেই উৎপাদন করা সম্ভব। বিকল্প জ্বালানি হিসেবে আমরা আরো অনেক উৎসর কথা জানি। বিশেষ করে সৌরশক্তিকে সোলার প্যানেলের মাধ্যমে বিদ্যুত্শক্তিতে রূপান্তরের প্রক্রিয়াটিকে এখন সবচেয়ে সহজ, সাশ্রয়ী, টেকসই ও পরিবেশবান্ধব বলে মনে করা হয়। নবায়নযোগ্য এই জ্বালানি তাই সারা বিশ্বেই এখন জনপ্রিয়। অধিক কার্বন নিঃসরণ কমিয়ে আনতে বড় বড় দেশ এই সাশ্রয়ী জ্বালানি উৎপাদনে বেশি মনোযোগী হয়ে উঠেছে। ২০২০ সালের প্রথমার্ধে বৈশ্বিক বিদ্যুতের ১০ শতাংশ উৎপাদিত হয়েছে বায়ু ও সৌরশক্তিকে কাজে লাগিয়ে। বাংলাদেশেও এর সাফল্যজনক উৎপাদন অভিজ্ঞতা রয়েছে। দেশের প্রত্যন্ত এলাকায় ৬০ লাখ সৌরবিদ্যুতের ইউনিট স্থাপন করা হয়েছে। বিশ্বে এটাই সর্বোচ্চ ইউনিট স্থাপনের রেকর্ড। ২০৪১ সালের মধ্যে দেশের বিদ্যুৎ চাহিদার শতকরা ৪০ ভাগ সৌরবিদ্যুৎ প্রকল্পের মাধ্যমে মেটানোর লক্ষ্য সরকার ঘোষণা করেছে।
সোলার হোম সিস্টেম এখন আমাদের দেশেও বেশ জনপ্রিয়। তবে গত কয়েক বছরে এটি নিয়ে যত কাজ হয়েছে এবং মানুষের মধ্যে যে ব্যাপক আগ্রহ তৈরি হয়েছিল, তা কমে আসে আমাদের কিছু ভুল কৌশল ও ব্যবস্থাপনার কারণে। দেশের সব প্রান্তে পল্লী বিদ্যুৎ পৌঁছানোর চেষ্টা না করাই ভালো ছিল। ওই সব এলাকায় সোলার হোম বা মিনি গ্রিড পদ্ধতি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিল। সস্তায় বিদ্যুৎ পাওয়ার লোভে ‘আমও গেল ছালাও গেল’ অবস্থা এখন। সোলার হোম সিস্টেম এ দেশে প্রয়োগ শুরু হয় আশির দশক থেকে। পরবর্তী সময়ে ইনফ্রাস্ট্রাকচার ডেভেলপমেন্ট কম্পানি (ইডকল) এই কর্মসূচিকে ব্যাপক আকারে গ্রহণ করে। এটিই বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় নবায়নযোগ্য জ্বালানি কর্মসূচি। বাংলাদেশ ব্যাংকের মাধ্যমে এখানে বড় ধরনের অর্থায়নের সুযোগও রয়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ব্যাংক ছোট ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের জন্য পাঁচ বছর মেয়াদি যে ২৫ হাজার কোটি টাকার তহবিল তৈরি করেছে তার এক-পঞ্চমাংশ ইডকলকে দেওয়া হোক সোলার সেচ প্রচলনের জন্য। আমরা দেখেছি ইডকলের সহযোগিতায় গ্রামীণ শক্তি, ব্র্যাক, সৃজনী, আরএফডিসহ অনেক এনজিও দুর্গম এলাকায় বিদ্যুৎ র্পৌঁছে দিতে সক্ষম হয়েছে। কোনো কোনো এনজিও দুর্গম চর এলাকা এবং উপকূলীয় অঞ্চলেও বিদ্যুৎ সম্প্রসারিত করেছে। এই খাতে আমাদের অগ্রগতি ও অবস্থান খুব একটা খারাপও ছিল না। রিনিউয়েবল ২০২০ গ্লোবাল স্ট্যাটাস রিপোর্ট মতে, সৌরপদ্ধতিতে বিদু্যুৎ উৎপাদনে নেপালের পরই ছিলাম আমরা। অন্তত আমরা ৮ শতাংশ বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছিলাম, নেপাল যেখানে ১১ শতাংশ উৎপাদন করে শীর্ষে ছিল। সোলার হোম সিস্টেমের কল্যাণে বিদ্যুৎ সুবিধার আওতায় চলে এসেছে পিছিয়ে পড়া গ্রামগুলো। এই খাতকে মাস্টার প্ল্যানের আওতায়ও আনা হয়েছে। এর পাশাপাশি গ্রামগঞ্জে সোলার স্ট্রিট লাইট প্রকল্পটির প্রসারের কথাও বলতেই হয়। নয়া বাস্তবতায় এসব উদ্যোগের কদর আরো বাড়ছে। সরকারও জাতীয় গ্রিডে সৌরবিদ্যুৎ যুক্ত করার জন্য অনেক ছোট ও মাঝারি প্রকল্প হাতে নিয়েছে।
কৃষি উৎপাদন খরচে একটি বড় ব্যয় সেচ। পানি না দিলে ফসল হয় না। কিন্তু ডিজেলভিত্তিক সেচপদ্ধতি এখনো সেভাবে আমরা কমিয়ে আনতে পারিনি বলেই প্রতীয়মান। অথচ সোলার ইরিগেশন পাম্প এ ক্ষেত্রে কার্যকর পরিবেশবান্ধব সমাধান হতে পারে। বরগুনা, ভোলা, কুষ্টিয়া, পাবনার বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চলে আলাপ করে আমরা জেনেছি, এখানকার কৃষকরা সোলার সিস্টেম দিয়ে তোলা পানি ফসল উৎপাদনে ব্যবহার করছেন। সেখানে তাঁরা লাভবানও হচ্ছেন। মাত্র ৩৫ লাখ টাকা দিয়ে কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার চিতলিয়া ইউনিয়নে একটি কৃষক দল সমিতি করে সোলার পাম্প বসিয়ে নিজেদের মাঠে পানি দেওয়া নিশ্চিত করেছে। এই ধরনের আরো অনেক দরকার। সরকার কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণকে উৎসাহ দেওয়ার জন্য প্রতিটি যন্ত্রের মূল্যের ৫০ শতাংশ ভুর্তকি দেওয়ার কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। কম্বাইন্ড হার্ভেস্টারের জন্যই বেশি করে তা দেওয়া হচ্ছে। এর সঙ্গে সোলার ইরিগেশন পাম্প বাবদ এমন বিনিয়োগের সুযোগ দিলে গ্রামবাংলায় সবুজ জ্বালানির সবুজ বিপ্লব ঘটে যাবে বলে আমার বিশ্বাস। যখন সেচ চলবে না তখন ঘরে ঘরে চলে যাবে বিদ্যুৎ। এভাবেই বদলে ফেলা যায় বিদ্যুতের চালচিত্র।
এটা তো মানতেই হবে যে ধাপে ধাপে জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমিয়ে সবুজ জ্বালানির ওপর নির্ভরশীল হওয়াই আমাদের লক্ষ্য। তবে বিরাট এই পরিবর্তনে তাড়াহুড়া না করে রূপান্তর প্রক্রিয়াটিকে যতটা সম্ভব মসৃণ করাই এ ক্ষেত্রে গ্রহণীয় কৌশল। বিদ্যমান বাস্তবতায় সবুজ জ্বালানির দিকে যাওয়ার তাগিদ বেড়েছে। তবে এখানেও ভেবেচিন্তে এগোনোর বিকল্প নেই। ফলে জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহারও অব্যাহত রাখতে হবে আরো অনেক দিন। তবে জীবাশ্ম জ্বালানি আমদানি যতটা সম্ভব কমাতে দেশীয় কম্পানির মাধ্যমে নতুন নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান এবং গ্যাস উত্তোলন প্রক্রিয়ায় বাড়তি গতি সঞ্চার করতে হবে। জ্বালানি আমদানি করার ক্ষেত্রেও অর্থনৈতিক স্বার্থকে যতটা সম্ভব সুরক্ষা দিতে হবে। একই সঙ্গে প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে জ্বালানি বাণিজ্য ও সহযোগিতার বিষয়েও আরো নীতিমনোযোগ কাম্য। গত আগস্টে রামপালে মৈত্রী সুপার থারমাল পাওয়ার প্রকল্পের প্রথম ইউনিটের কাজ সম্পন্ন করার যৌথ ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশ ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী। আসছে বছরের শুরুতে বাকিটুকুও সম্পন্ন হবে বলে জানা গেছে। প্রকল্পটি শেষ হলে আরো এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ পাব। নিশ্চয়ই তাতে আমাদের বিদ্যুৎ খাতের ওপর চাপ অনেকটাই কমবে। গত ২৫ অক্টোবর নেপালের সম্মানিত রাষ্ট্রদূত আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে জানিয়েছেন যে এই মুহূর্তেই নেপাল বাংলাদেশকে ৫০-৬০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দিতে পারে। আর তাদের একটি মেগাপ্রকল্প শেষ হলে আরো বেশি বিদ্যুৎ তারা বাংলাদেশে রপ্তানি করতে পারবে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাতে প্রতিবেশী সহযোগী দেশগুলোর সঙ্গে পারস্পরিক সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো আরো প্রসারিত করা গেলে বিদ্যমান সংকটের একটি টেকসই সমাধান খুবই সম্ভব। তা ছাড়া টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ স্রেডাকে আরেকটু সক্ষমতা ও বাজেট সহায়তা দিলে ‘রুফটপ সলিউশন’সহ সারা দেশে সৌরবিদ্যুৎ উৎপাদন করে তা জাতীয় গ্রিডে যুক্ত করার গতি বেড়ে যাবে। এর সঙ্গে নেট মিটারিং ব্যবস্থাটি প্রণোদনাসহ ব্যাপক হারে গ্রহণ করলে প্রতিটি বাড়ির ছাদেই সোলার প্যানেল মানুষ নিজেই স্থাপন করবে। এভাবেই নীতি প্রণোদনা দিয়ে সাধারণ মানুষকেও বিদ্যুৎ উৎপাদনপ্রক্রিয়ায় যুক্ত করা গেলে জ্বালানি পরিস্থিতির আমূল পরিবর্তন করা নিশ্চয় সম্ভব।
লেখক : বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর
No comments