জলবায়ু অধিকারকর্মীদের হয়রানি বন্ধ করতে হবে

 


জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে একদিকে উপকূলের কয়েক কোটি মানুষ লবণাক্ততাসহ নানা সমস্যার মধ্যে আছে। আর উজানে সিলেটের মতো এলাকার অধিবাসীরা হঠাৎ বন্যাসহ নানা বিপর্যয়ের শিকার হচ্ছে। বাংলাদেশ মূলত তার নিজস্ব সম্পদ দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সহায়তা করছে। কিন্তু জাতিসংঘের সবুজ জলবায়ু তহবিল (জিসিএফ) থেকে এ ব্যাপারে পর্যাপ্ত সহায়তা পাচ্ছে না। জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষকে সহযোগিতাবিষয়ক বিশেষ র‍্যাপোটিয়ার ইয়ান ফ্রাইয়ের দেওয়া প্রতিবেদনে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়।

গতকাল রোববার রাজধানীর একটি হোটেলে ওই প্রতিবেদন তুলে ধরে এ ব্যাপারে সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত ব্যক্তি, কর্মকর্তা ও নাগরিক সমাজের মতামত নেওয়া হয়। বাংলাদেশে জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়কারী গোয়েন লুইসের সঞ্চালনায় প্রতিবেদনটির মূল বক্তব্য তুলে ধরেন পরিবেশ ও উন্নয়নবিষয়ক সংস্থা আইআইইডির নির্বাহী পরিচালক ড. সালিমুল হক। বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাসসহ বিভিন্ন দূতাবাস ও আন্তর্জাতিক সংস্থার শীর্ষস্থানীয় কর্মকর্তারা এতে বক্তব্য দেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, ইয়ান ফ্রাই বাংলাদেশের সিলেট ও খুলনা সফর করেন। দেশের নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিদের সঙ্গেও কথা বলেন। তাঁদের কাছ জানতে পারেন দেশের পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করা অধিকারকর্মীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন। মানুষের কথা বলার অধিকার সংকুচিত হচ্ছে। কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো জলবায়ুবান্ধব নয়, এমন প্রকল্পের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় সরকারি সংস্থাগুলো তাদের গ্রেপ্তার ও হয়রানি করছে।

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, পরিবেশ সুরক্ষা ও জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য ক্ষতিকর কাজের বিরোধিতা করায় অনেকেই ‘অজানা ব্যক্তির’ মাধ্যমে হত্যার হুমকি পাচ্ছেন। এতে আরও বলা হয়, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্পের মতো কাজের বিরোধিতা করায় অনেকেই হয়রানি ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলার আসামি হচ্ছেন।

প্রতিবেদনে বলা হয়, সরকার থেকে যদিও পরিবেশ ও জলবায়ু অধিকারকর্মীদের বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রয়োগের বিষয়টি অস্বীকার করা হয়েছে। তবে জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার বাংলাদেশ সফরের সময় যেসব মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে তদন্ত চেয়েছেন, তা দ্রুত সম্পন্ন করার জন্য সুপারিশ করে প্রতিবেদনে বলা হয়, ওই তদন্তের সঙ্গে নাগরিক সমাজের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

প্রতিবেদনে মোট ছয়টি সুপারিশ করা হয়েছে। প্রথমত, বাংলাদেশের মতো দেশ তার নিজস্ব তহবিল দিয়ে জলবায়ু পরিবর্তনের মতো ক্ষয়ক্ষতি মোকাবিলা করতে পারছে না। তাই জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টিকে আসন্ন বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে তুলে ধরা এবং এর জন্য একটি স্বতন্ত্র তহবিল তৈরির কথা বলা হয়েছে। পরিবেশ ও জলবায়ু সুরক্ষার জন্য কাজ করা অধিকারকর্মীদের হয়রানি ও মামলা করা বন্ধ করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক যেকোনো বিষয়ে জনসমক্ষে কথা বলার অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে সংশোধন করে তা জলবায়ু ও পরিবেশকর্মীদের এর আওতার বাইরে রাখতে হবে।

আলোচনা পর্বে বাংলাদেশে নিযুক্ত যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত পিটার হাস বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। নারী, শিশু ও ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলোর অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি সাবের হোসেন চৌধুরী বলেন, বাংলাদেশের মতো দেশসহ বিশ্ববাসীকে বাঁচাতে কার্বন নিঃসরণ কমাতে হবে।

অনুষ্ঠানে বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, চট্টগ্রামের বাঁশখালীতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করায় ১২ জনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিরুদ্ধে মন্তব্য করায় এক তরুণকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করে কারাগারে রাখা হয়েছে। এ ছাড়া সিরাজগঞ্জ ও নেত্রকোনার মতো এলাকায় খেলার মাঠ দখল করে আশ্রয়ণ প্রকল্প করা হচ্ছে। এর প্রতিবাদ করায় স্থানীয় লোকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এভাবে প্রতিবাদ থামাতে থাকলে দেশের পরিবেশ রক্ষার জন্য কাউকে পাওয়া যাবে না।

সরকারের এসডিজি–বিষয়ক সাবেক সমন্বয়কারী আবুল কালাম আজাদ বলেন, সরকার অনেক ভালো কাজ করছে। সেগুলো এই প্রতিবেদনে খুব বেশি উঠে আসেনি। কিন্তু নাগরিক সমাজ ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার কাজগুলোকে বেশি ইতিবাচকভাবে তুলে আনা হয়েছে। আর বাঁশখালীর কয়লাবিদ্যুৎকেন্দ্র এলাকায় ১২ জনের মৃত্যুর বিষয়টি স্থানীয় জমিজমা নিয়ে কোন্দলের কারণে হয়েছে।

অনুষ্ঠানে চাকমা রাজা দেবাশিস রায় বলেন, পাহাড়ে ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীগুলো নিজস্ব ব্যবস্থাপনায় পরিবেশ ও বন রক্ষা করছে। করোনার প্রকোপের সময় পাহাড়ের জুম চাষের চাল, সবজি ও ফল খেয়ে মানুষ টিকে থেকেছে। তাই পাহাড়ের মানুষের নিজস্ব সংস্কৃতি ও চর্চাগুলোকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলার কাজে ব্যবহার করতে হবে।

অনুষ্ঠানে সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার বলেন, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় দেশের কয়েকটি গ্রামকে প্রস্তুত করার জন্য তাদের সংগঠন কাজ করছে। এভাবে দেশের প্রতিটি গ্রামকে প্রস্তুত করতে হবে।


No comments

Theme images by nicodemos. Powered by Blogger.