শিল্প কারখানার বর্জ্য, প্লাস্টিক ও ময়লা ফেলার স্থান হিসেবে দেশের বিভিন্ন এলাকার নদী ব্যবহার হচ্ছে। এমন দূষণ ও দখলের কারণে ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে নদীগুলো। দূষণের কারণে নদীগুলোতে জলজ প্রাণীর অস্তিত্বও হুমকির মুখে। এছাড়া এর কারণে নদীনির্ভর প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনজীবিকা, কৃষি, খাদ্য নিরাপত্তা, নিরাপদ পানির জোগানও হুমকির মুখে পড়বে।
সম্প্রতি দেশের ৫৬টি প্রধান নদনদীর ওপর করা এক গবেষণার তথ্য বলছে, দেশের সবচেয়ে দূষিত নদী গাজীপুরের লবণদহ, নরসিংদীর হাঁড়িধোয়া ও হবিগঞ্জের সুতাং। এ গবেষণায় ৫৬টি নদনদীতেই সহনীয় মাত্রার চেয়ে বেশি দূষণের অস্তিত্ব মিলেছে, তবে তুলনামূলক বেশি দূষিত নদী এই তিনটি। গবেষকরা বলছেন, নদীগুলোকে আগের রূপে ফিরিয়ে নিতে শিল্প কারখানা, পয়োনিষ্কাশন ও বর্জ্য নিষ্কাশনের সুষুম ব্যবস্থাপনার ওপর গুরুত্ব দিতে হবে।
রিভার অ্যান্ড ডেল্টা রিসার্চ সেন্টারের (আরডিআরসি) উদ্যোগে দেশের ৫৬টি প্রধান নদনদীর দূষণ নিয়ে এক বছরব্যাপী গবেষণা করা হয়। ২০২২ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত চলমান এ গবেষণাকর্ম চলে। গবেষণায় ৫৬টি নদীর পানির গুণাগুণ পরিমাপ করে দেখা গেছে, শুধু শহর বা উপশহরে নয়, প্রত্যন্ত অঞ্চলের নদীতেও প্লাস্টিক ও শিল্পবর্জ্যের দূষণ ছড়িয়ে পড়েছে। নদী বহমান, তাই দূষণ স্রোতের সঙ্গে সঙ্গে এক নদী থেকে অন্য নদীতে ছড়ায়।
৫৬টি নদীর মধ্যে তিনটি নদীর অবস্থা সবচেয়ে বেশি খারাপ। এছাড়া ঢাকার আশপাশের নদীগুলোর অবস্থাও খারাপ। বৃষ্টি না হলে এখানে কোনোভাবেই দূষণ কমছে না। অক্সিজেনের মাত্রা কম হওয়ায় এসব নদীতে প্রাণীর অস্তিত্ব হারাচ্ছে। যা খুবই ভয়ংকর। গবেষণার তথ্যমতে, সবচেয়ে দূষিত তিন নদীর পানির গুণাগুণ প্রায় সমান। লবণদহ, হাঁড়িধোয়া ও সুতাংয়ে পানির ক্ষারতার পরিমাণ যথাক্রমে ৫ ও ৪ দশমিক ১ এবং ৪। পানি বিজ্ঞানীদের মতে, বিশুদ্ধ পানির পিএইচ বা ক্ষারের পরিমাণ ছয় থেকে সাতের মধ্যে থাকতে হয়। এর কম হলে পানিকে আম্লিক এবং বেশি হলে ক্ষারীয় বলা হয়। পিএইচের মানমাত্রা বেশি ও কম দুটিই মানব স্বাস্থ্যের জন্য ভয়াবহ ক্ষতিকর।
তিন নদীর পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেনের মানমাত্রা ভয়াবহ রকম কম। লবণদহে অক্সিজেনের পরিমাণ শূন্য দশমিক ২১, হাঁড়িধোয়ায় শূন্য দশমিক ৬ ও সুতাংয়ে শূন্য দশমিক ৪। পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পানি বিজ্ঞানীদের তথ্য অনুযায়ী জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকার জন্য দ্রবীভূত অক্সিজেনের পরিমাণ অবশ্যই ৪ দশমিক ৫ থেকে ৮ মাত্রায় থাকতে হবে। না হলে জলজ প্রাণীর বেঁচে থাকা সম্ভব না। এই তিন নদীর দূষণের প্রধান কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে যত্রতত্র প্লাস্টিকের ব্যবহারকে। অপর দুই বড় কারণ হলো—নদী তীরবর্তী শিল্প কারখানাগুলোর বর্জ্য ব্যবস্থাপনা না থাকা, সেসঙ্গে পৌরসভাগুলোর ময়লা ফেলার জন্য নদীকে বেছে নেওয়া। এ বিষয়ে আরডিআরসির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ এজাজ বলেন, আমরা দেখলাম এমন কোনো নদী নেই যেখানে দূষণ নেই। এর কারণ হলো প্রত্যন্ত অঞ্চলেও এখন শিল্প কারখানা নির্মাণ হচ্ছে। ফলে দেখা গেছে, সুন্দরবনের আশপাশের নদীতেও দূষণ পাওয়া গেছে। নদীর স্রোত বয়ে চলে, তাই গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে চলা নদীতেও দূষণ ঘটছে। এছাড়া সব নদীতেই বিভিন্ন উত্স থেকে প্লাস্টিক দূষণও পাওয়া গেছে প্রচুর।’
No comments